১০ টি মার্কেটিং বই যা মার্কেটার, ছাত্র, উদ্যোক্তাদের অবশ্যই পড়া উচিৎ। তালিকায় যাওয়ার আগে জেনে নিই কেন পড়বেন? আর মার্কেটিং শেখার সেরা উপায় কি? ট্রেইনিং করবেন, নাকি বই পড়বেন, নাকি উভয়ই? আমার এই প্রশ্নেই হয়তো মার্কেটিংগুরুরা আপত্তি করবেন। বলতে পারেন এতো সহজেই কি মার্কেটিং শেখা যায়! তাই এই প্রশ্নের গভীরে না গিয়ে এটা অন্তত খুঁজে দেখতে পারি মার্কেটিং বই কেন পড়বেন?
প্রথম পয়েন্ট বর্তমান সময়ের জন্য নিজেকে উপযুক্ত করতে আপনাকে বই পড়তে হবে। কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি ধরাবাঁধা কিছু বই পড়েছেন, তার বেশ কিছু বই অনেক আগে লেখা। আর ব্যবসায় জগৎ সদা পরিবর্তনশীল। তাই হালনাগাদ জ্ঞানের জন্য বই পড়তে হবে। আর পাঠ্যবইয়ের বাইরে জ্ঞানের জগৎটা বেশি বড়, সেখান থেকে আপনাকে গ্রহণ করতে হবে।
বর্তমানে মার্কেটিং-এ শুধু মার্কেটিং-এর ছাত্ররাই আসছে না, অন্যান্য ডিসিপ্লিন থেকেও ছাত্ররা বাজারজাতকরণ পেশায় ঢুকছে। এমনকি নন-কমার্সের ছাত্রদেরও মার্কেটিঙে যেতে হচ্ছে। আর উদ্যোক্তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনো শাখায় আবদ্ধ নয়। যে কেও উদ্যোগ নিতে পারেন।
আর শুধু মার্কেটিং পেশাজীবি নন, যে কোনো উদ্যোক্তাকে মার্কেটিং বই পড়তে হবে তার ব্যবাসয়কে খোলা সাগরে সঠিক দিশা দিতে।
বই পড়া শেখার একটি কার্যকরী উপায়, কারণ বই আপনার মনকে শুধু একটি কাজ মন দিতে করতে বাধ্য করে। আপনি কি কখনও লক্ষ্য করেছেন যে একই সময়ে হেডফোনে কিছু শোনা, হাঁটাহাঁটি করা এবং প্রকৃতির দিকে তাকানো কত সহজ? কিন্তু আপনি যখন বই পড়ছেন তখন একসাথে এগুলো করা অনেক কঠিন। তাই বইটা আপনাকে মনযোগ দিয়েই পড়তে হয়।
আপনি যখন একটি বই পড়েন, আপনি আক্ষরিক অর্থে লেখকের মাথায় থাকা তথ্যগুলো সামান্য পরিশ্রমে নিয়ে নিচ্ছেন যে জ্ঞান তাকে অর্জন করতে হয়েছে দীর্ঘ সময়ে ও প্রচেষ্টায়। আর যেহেতু লেখকরা জানেন তার লেখা পড়বে হাজার হাজার বা লাখ লাখ বা সারা পৃথিবীর মানুষ তখন তিনি চেষ্টা করেন সর্বোত্তমভাবে বইটা লিখতে। এই কারণেই বই জাদুকরী।
সত্যি কথা বলতে মাত্র কয়েক বছর আগেও বাংলা ভাষায় পাঠ্য বইয়ের বাইরে মার্কেটিঙের বইয়ের খুব অভাব ছিল। এখনও খুব আছে তা বলা যাবে না, তবে অনাবাদী ক্ষেত্রটায় এখন চাষ হচ্ছে। প্রতিবছরই বেশ কিছু বই বের হচ্ছে, কয়েকজন প্রতিথযশা লেখক যারা গবেষক বা মার্কেটিং পেশায় দশকের বেশি পোড়খাওয়া তারা লিখছেন, সবচে বড় কথা তারা লিখছেন সহজ ভাষায়। মার্কেটিঙের ব্যবহারিক দিক, দেশের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন কেস স্টাডি এসব থাকছে বইগুলোতে।
এছাড়া প্রচুর বই অনুবাদ হচ্ছে। তবে অনুবাদের ক্ষেত্রে কিছু নেতিবাচক কথা বলার সুযোগ আছে। কারণ যে অনুবাদগুলো হচ্ছে তার বেশিরভাগের অনুবাদ মানসম্মত নয়। বাজারে চাহিদার দিক মাথায় রেখে পাইকারি হারে অনুবাদ হচ্ছে, সেগুলো কাঠখোট্টা শাব্দিক অনুবাদ হচ্ছে। আর ইংরেজি বই পড়তে চাইলে অসংখ্য ভাল ভাল বই আছে, গুগল করলে সহজে পেয়ে যাবেন। কিন্তু এই ব্যতিক্রম তালিকাটি করেছি দেশী লেখকদের বই ও ভাল মানের কিছু অনুবাদ নিয়ে:
১০ টি মার্কেটিং বই:
১. গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং
লেখক : মুনির হাসান
প্রকাশনী : আদর্শ
এটি আসলে অনুবাদ, তবে লেখক অনুবাদ করেছেন নিজস্ব ঢঙে, মূল লেখকের বাইরেও নিজস্ব চিন্তার প্রকাশ করেছেন বইয়ে। গ্রোথ হ্যাকিং হলো এমন একটি মার্কেটিং-পদ্ধতি, যার সঠিক ব্যবহার শুধু নবীন উদ্যোক্তা নন, প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তাদেরও গ্রোথ বাড়াতে সহায়তা করে।
স্টার্টআপ ব্যবসায়গুলোর মার্কেটিং এর পেছনে ব্যয় করার তেমন সামর্থ থাকে না। তাদের জন্য গ্রোথ হ্যাক মার্কেটিং হল লাইফলাইন। কোনো বিজ্ঞাপন না দিয়ে গ্রাহককে স্বেচ্ছায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যম বানানো হলো গ্রোথ হ্যাক মার্কেটিং।
মার্কেটিং এর পুঁথিগত ধারণাকে না টেনে বিভিন্ন ধরনের কোম্পানির উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে মার্কেটিং এর নানান কৌশল।
নিজের গ্রোথ হ্যাক করা, প্রচার করা, ভাইরালিটি, গ্রোথ ধরে রাখা সহ এরকম মার্কটিং-পদ্ধতির বিস্তারিত নিয়ে লেখা হয়েছে বইটি।
২. ব্র্যান্ড বিষয়ক
প্রকাশনী : পেন্ডুলাম পাবলিশার্স
বইটিকে বলা যেতে পারে বাংলা ভাষায় ব্র্যান্ডিঙের ম্যানুয়াল। বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধাপে ধাপে ব্র্যান্ডিঙের গতিপথ সহজ করে বুঝানো হয়েছে।
একটা ব্র্যান্ডের জন্ম, নামকরণ, ব্র্যান্ড প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রথম প্রকাশ, তার এগিয়ে যাওয়া, প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে “যুদ্ধ”, সাফল্য, পতন সবই লেখক উপস্থাপন করেছেন। ব্র্যান্ড কেন সফল হয়, কীভাবে বিফল হয় এসব বিভিন্ন দেশীয় এবং বিদেশি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো হয়েছে।
বাংলা ভাষায় ব্র্যান্ড বিষয়ে এটাই সম্ভবত সবচে’ সেরা বই। বইয়ের বহর অনুযায়ী দাম বেশি মনে হয়েছে, তবে পড়তে গিয়ে আর এটি মাথায় থাকে নি। অফার ছাড়া সাধারণর অবস্থায় গায়ের দামে কিনতে হবে। প্রলয় হাসান নাম উল্লেখ না করে বলেছেন বইটি গায়ের মূল্যে বিক্রির স্ট্র্যাটেজিতে না গেলে বেস্ট সেলার হতে পারত। এই বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়া উচিৎ।
৩. ১০০ গ্রেট মার্কেটিং আইডিয়া
লেখক : জিম ব্লাইথ
প্রকাশনী : নন্দন
এই আইডিয়াগুলো ইউনিক না, কেউ না কেউ কোথাও প্রয়োগ করেছে, আর এজন্যই আইডিয়াগুলো পরীক্ষিত। বিশ্বের নামকরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন উদ্ভুত পরিস্থিতি বলা চলে বেকায়দা পরিস্থিতিতে সৃজনশীল আইডিয়া প্রয়োগ করে সেটি সামাল দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে সেই রকম কার্যকরী ১০০ টি আইডিয়া ও তার প্রয়োগ সংকলন করেছেন লেখক জিম ব্লাইথ।
আইডিয়াগুলো কারা প্রয়োগ করেছে, এবং কোনো ধরণের প্রতিষ্ঠান কী পরিস্থিতিতে তা প্রয়োগ করতে পারে সেটি সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন। জাদুকরি কোনো বই নয়, এমনকি বিশদ গবেষণাও নয় কিন্তু অবশ্যপাঠ্য।
৪. নন-মার্কেটারদের জন্য মার্কেটিং
লেখক : প্রলয় হাসান
প্রকাশনী : আদর্শ
যদিও নাম নন-মার্কেটারদের জন্য, আসলে এটি মার্কেটারদের জন্যই, এটি মার্কেটিঙের কাঠখোট্টা ভাষার বাইরে এতোটাই সরল ভাষায় লেখা, নন মার্কেটাররাও বুঝবে। লেখক প্রলয় হাসানের নিজের ভাষায় “এটি শুধু আমার জীবনের প্রথম বই-ই নয়, এটি খুব সম্ভবত বাংলা ভাষায় লিখিত মার্কেটিংয়ের দেশী কেসস্টাডির প্রথম পূর্ণাঙ্গ বই।” যদিও বইয়ে কয়েকটা বিদেশী কেস স্টাডি আছে। একাডেমিক বইগুলাতে যেসব কেইস স্টাডি থাকে, সেগুলো প্রায় সবই বিদেশি প্রেক্ষিতে লিখা, যা অনেক সময়েই দেশের প্রেক্ষিতে রিলেট করা কঠিন। তাই সোজা ভাবে বলতে গেলে, যাদের বিভিন্ন কোম্পানির কেইস স্টাডি নিয়ে জানার আগ্রহ আছে, (দেশী+বিদেশি) তাদের এটি অবশ্যপাঠ্য।
৫. ঠিক-বেঠিক মার্কেটিং
লেখক : গালীব বিন মোহাম্মদ
প্রকাশনী : আদর্শ
বইটিতে মার্কেটিং+ব্র্যান্ডিং সম্পর্কিত বিভিন্ন কিছু এত সুন্দর ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে একদম সহজ ভাষায় যে একজন নন-মার্কেটিং ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষ ও খুব সহজেই বুঝতে পারবে বিষয় গুলো। বইটির মূল বিষয় হচ্ছে কোনটি আসলে মার্কেটিং আর কোনটি নয় ।
এছাড়া আমাদের পরিচিত ব্র্যান্ড গুলো যেমন, বিকাশ, নগদ, লাক্স, ক্লোজ আপ, কোকোলা নুডুলস ছাড়াও আরো অসংখ্য ব্র্যান্ডের একদম বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে লেখক খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন মার্কেটিং কিংবা ব্র্যান্ডিং এ কী করা ঠিক আর কী করা ঠিক না, তাই এর নাম “ঠিক বেঠিক মার্কেটিং”।
৬. হালাল মার্কেটিং
লেখক : প্রলয় হাসান
প্রকাশনী : আদর্শ
বইয়ের নাম হালাল মার্কেটিং হলেও বইয়ে আরও দুটি টপিকে আলোচনা করা হয়েছে, নৈতিক মার্কেটিং ও পরিবেশবান্ধব মার্কেটিং। বইটিতে লেখক প্রথমেই মার্কেট সাইজ ও হালাল মার্কেটের বাজারমূল্য উল্লেখ করে দেখিয়েছেন কেন হালাল মার্কেটিং করা প্রয়োজন এবং কীভাবে এটি লাভজনক। লেখক দেখিয়েছেন ইসলাম অবমাননার দায়ে কোন কোন কোম্পানি কতটা ক্ষতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলো।
৭. নিজের ভাষায় মার্কেটিং সিরিজ (৩টি বই)
৭.১ নিজের ভাষায় মার্কেটিং
মার্কেটিং-এর গতানুগতিক তত্বীয় আলোচনার বাইরে গিয়ে লেখক বাস্তব ভিত্তিক উদাহরণের মাধ্যমে কিছু সহজভাবে মার্কেটিং প্রক্রিয়াকে তুলে ধরেছেন। সাধারণের ধারণা বিক্রির উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করাই হল মার্কেটিঙের প্রথম ধাপ। আসলে মার্কেটিং প্রক্রিয়া শুরু হয় অনেক আগে থেকে, এমনকি ব্যবসায় শুরুর আগে থেকে। লেখকের মথে প্রথম ধাপ হল বাজার গবেষণা। এরপর পণ্যের মূল্য নির্ধারণ, স্থান, প্রচার, মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি- এসব সহজ বাংলায় লেখা হয়েছে বইয়ে। শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, মার্কেটিং ক্যারিয়ের যুক্ত যে কারো জন্য অবশ্যপাঠ্য বই।
৭.২ নিজের ভাষায় ব্র্যান্ডিং
৭.৩ নিজের ভাষায় মার্কেটিং প্ল্যানিং
১০. মার্কেট রিসার্চ অথবা সরল-সোজা বাজার গবেষণা
প্রকাশনী: স্বরে অ
আগে কোম্পানি বড় হবে তারপর বাজার গবেষণা করবো? নাকি শুরু থেকেই বাজার গবেষণা করা হলেই কোম্পানি বড় করার রসদ মিলবে”- এই প্রশ্নের ও একটা উত্তর পেয়ে যাবেন।
১১. স্মার্ট মার্কেটিং
মার্ক অনুপম মল্লিক বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একজন মার্কেট প্র্যাকটিশনার গবেষক, প্রশিক্ষক ও লেখক। তার স্মার্ট মার্কেটিং বইটি পরিবর্তিত বিশ্বের নতুন মার্কেটিং এপ্রোচ এর একটা ব্লুপ্রিন্ট বলা হচ্ছে। বইতে থাকা স্মার্ট মার্কেটিং ফ্রেমওয়ার্ক, দেশি বিদেশি কেইস স্টাডি মার্কেটার এবং উদ্যোক্তাদের AI এর দুনিয়াতে সঠিক ভাবে মার্কেটিং করতে দিক নির্দেশনা দেবে।
অবশ্যপাঠ্য না, তবে পড়া ভাল:
প্রকাশনী : আদর্শ
এটিও আসলে অনুবাদ, তবে নামকরণ আমার পছন্দ হয় নি। ইংরেজি “স্মুদি”র যায়গায় বাংলায় “শরবত” করেছেন অনেক কষ্টে, সেজন্য বিস্তর ব্যাক্ষাও দিতে হয়েছে। বইটি এটি সম্মিলিত ব্যবসায় উদ্যোগের জন্ম, সংগ্রাম ও উত্থানের গল্প। সরাসরি মার্কেটিং শেখার বই না। মার্কেটিং-এর একাডেমিক জ্ঞান না থাকলেও একটি টিম কিভাবে সফল হতে পারে তা জানার, সেই সফল প্রতিষ্ঠানের জীবনী পড়ে সেখান থেকে কিছু শেখার, কিছু মোটিভেশন নেবার বই।
10 টি মার্কেটিং বই