আপনি নিশ্চই কাছাকাছি কোথায় ওষুধের দোকান আছে, বা এটিএম বুথ আছে, বা নতুন কোনো যায়গায় গেলে কোথায় মসজিদ আছে তা গুগল ম্যাপে সার্চ করেছেন? বা পিজার দোকান কোথায়? গুগল ম্যাপ আপনার অবস্থানের কাছাকাছি পিজার দোকানটি দেখিয়ে দিয়েছে। এই পিজার দোকান মালিক তার ব্যবসায়কে গুগলে অপটিমাইজ করেছে, তাই আপনি তারটি আগে দেখেছেন।

গুগল বিজনেস প্রোফাইল: আপনার ব্যবসাকে সবার সামনে আনুন

২০১৪ সালের জুনে গুগল Google My Business নামে একটি নতুন ফিচার চালু করেছিল, যা এখন Google Business Profile নামে পরিচিত। যারা ফিজিক্যাল দোকান বা ব্যবসা পরিচালনা করেন, তাদের জন্য এটি একটি দারুণ ফ্রি টুল। আপনার ব্যবসা যদি কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় থাকে, তাহলে এই প্রোফাইল থাকার মানে হলো স্থানীয় ক্রেতারা সহজেই আপনাকে খুঁজে পাবে।

অনেকে হয়তো শুধু ব্যবসার নাম, ঠিকানা আর খোলার সময় দিয়ে প্রোফাইল তৈরি করে রাখেন। কিন্তু যদি আপনি আপনার প্রোফাইলটি নিয়মিত আপডেট করেন এবং সক্রিয়ভাবে এটি পরিচালনা করেন, তাহলে আরও বেশি গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে পারবেন। এছাড়াও, গ্রাহকদের যদি রিভিউ দিতে উৎসাহিত করতে পারেন আর যদি তারা রিভিও দেয় তবে তা আপনার ব্যবসাকে সার্চ রেজাল্টের উপরের দিকে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সমস্ত গুগল বিজনেস প্রোফাইল সার্চ রেজাল্টে উপরের দিকে থাকে, তাদের বর্ণনায় প্রায় ৭০টি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্যদিকে, যারা নিচের দিকে ছিল, তাদের বর্ণনা ছিল বেশ সংক্ষিপ্ত। একই গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, যেসব ব্যবসার প্রোফাইল বেশি দেখা যায়, তাদের ২০০টিরও বেশি রিভিউ ছিল, যেখানে নিচের দিকের ব্যবসার রিভিউ অনেক কম ছিল। এর মানে হলো, আপনার বর্তমান কন্টেন্টে ছোটখাটো পরিবর্তন এবং নিয়মিতভাবে প্রোফাইল আপডেট করলে আপনার ব্যবসাকে সবার থেকে আলাদা করে তুলতে পারে এবং স্থানীয় সার্চ র‍্যাঙ্কিংয়ে উপরে উঠতে সাহায্য করে।

চলুন, আমরা জেনে নিই কীভাবে আপনার সাধারণ গুগল বিজনেস লিস্টিংটিকে একটি শক্তিশালী অনলাইন উপস্থিতিতে রূপান্তর করবেন, যা আরও বেশি গ্রাহককে আপনার দোকানে নিয়ে আসবে।

গুগল বিজনেস প্রোফাইল কী?

গুগল বিজনেস প্রোফাইল (Google Business Profile) হলো একটি ফ্রি অনলাইন লিস্টিং, যা আপনার দোকান বা ব্যবসার তথ্য Google Search ও Google Maps-এ দেখায়।
এই প্রোফাইলে থাকে—

  • দোকানের ঠিকানা
  • ফোন নম্বর
  • খোলার ও বন্ধ হওয়ার সময়
  • ছবি ও গ্রাহকদের রিভিউ

এটি এক ধরনের ডিজিটাল ফ্রন্টডোর বা ডিজিটাল দোকানের সাইনবোর্ড, যা মানুষকে আপনার ব্যবসা সম্পর্কে আগে থেকেই ধারণা দেয়—তারা ওয়েবসাইটে ঢোকার আগেই।


কেন গুগল বিজনেস প্রোফাইল গুরুত্বপূর্ণ?

একটি সম্পূর্ণ ও আকর্ষণীয় প্রোফাইল দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ করে যায় আপনার জন্য। এটি—

  • সম্ভাব্য ক্রেতাদের নজর কাড়ে
  • তাদের সাধারণ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে দেয়
  • এবং শেষ পর্যন্ত তাদের কেনাকাটার বা বুকিং করার দিকে নিয়ে যায়

সোজা ভাষায়—ভালোভাবে গুছানো গুগল প্রোফাইল = বেশি কাস্টমার


গুগল বিজনেস প্রোফাইল ব্যবহারের কিছু মূল সুবিধা

১. প্রথম দেখাতেই ভালো ইমপ্রেশন

ধরুন, একই এলাকায় দুটি বুটিক দোকান আছে। একটির গুগল প্রোফাইলে কোনো ছবি নেই, আর তথ্যগুলো পুরনো। আর অন্য দোকানটির প্রোফাইলে আছে সুন্দর ছবি, হালনাগাদ সময়সূচি ও ইতিবাচক রিভিউ।

অবশ্যই দ্বিতীয় দোকানটি কাস্টমারের কাছে অনেক ভালো ইমপ্রেশন তৈরি করবে।

২. সাধারণ প্রশ্নের উত্তর আগেই পাওয়া যায়

অনেক সময় দোকানে থাকা অবস্থায় বারবার ফোন ধরে বলতে হয়:
“আজকে খোলা আছে?”, “লোকেশন কোথায়?”, “হুইলচেয়ার ঢোকে?” ইত্যাদি।

একটি ভালোভাবে সেটআপ করা গুগল প্রোফাইল এসব প্রশ্নের উত্তর আগেই দিয়ে দেয়—ফোন ধরার ঝামেলা কমে যায়, আর আপনি দোকানের ভেতরে কাস্টমারদের বেশি মনোযোগ দিতে পারেন।

উদাহরণ: যদি আপনার হোম ডেকোর দোকানে “Wheelchair-accessible entrance” বা “In-store pickup available” লেখা থাকে প্রোফাইলে, তাহলে মানুষ ফোন না করে সোজাসুজি চলে আসবে।

৩. ক্রয় সিদ্ধান্তে সাহায্য করে

অনেকেই যখন গুগলে আপনার দোকান খোঁজে, তারা কিনতে প্রস্তুত থাকে—শুধু একটি ধাক্কার অপেক্ষায়।
যদি প্রোফাইলে থাকে—

  • “Visit Website”
  • “Order Online”
  • “Call”
  • “Get Directions”

তাহলে তারা সাথে সাথে অ্যাকশন নিতে পারে—অর্ডার করতে পারে বা দোকানে চলে আসতে পারে।

আজকের দিনে, মানুষ গুগলে ব্যবসা খোঁজে তারই ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়।
একটি পূর্ণাঙ্গ ও আপডেটেড গুগল বিজনেস প্রোফাইল আপনাকে এগিয়ে রাখে প্রতিযোগীদের চেয়ে।

সঠিকভাবে গুছানো প্রোফাইল মানে—বেশি ভিজিটর, বেশি গ্রাহক, এবং বেশি বিক্রি।


কীভাবে গুগল বিজনেস প্রোফাইল অপটিমাইজ করবেন?

গুগল বিজনেস প্রোফাইল অপটিমাইজ করা শুনতে জটিল মনে হলেও, আসলে এটি খুব সহজ একটি কাজ। নিচে ধাপে ধাপে বলা হলো কীভাবে আপনি আপনার প্রোফাইল উন্নত করে আরও বেশি গ্রাহক পেতে পারেন।

১. সঠিক ক্যাটাগরি ও কিওয়ার্ড ব্যবহার করুন

গুগলের তালিকায় ৪,০০০-এরও বেশি ব্যবসায়িক ক্যাটাগরি রয়েছে—যার মধ্যে “Clothing Store”-এর মতো সাধারণ বিভাগ থেকে শুরু করে “Piñatas supplier”-এর মতো বিশেষায়িত ক্যাটাগরিও রয়েছে।

আপনার ব্যবসার প্রকৃতি অনুযায়ী সবচেয়ে উপযুক্ত ক্যাটাগরি নির্বাচন করুন।
যেমন: আপনি যদি একটি পুরনো ডেনিম বিক্রির দোকান চালান, তাহলে সাধারণ “Clothing Store” না দিয়ে “Vintage Clothing Store” নির্বাচন করাই ভালো। এতে আপনার প্রোফাইল সঠিক সার্চে ভেসে উঠবে।

কিওয়ার্ড যুক্ত করুন:
আপনার ব্যবসার বিবরণ অংশে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করুন যা মানুষ সার্চ করে।
যেমন: “ঢাকায় পোষা প্রাণীর খাবার” বা “রাজশাহীতে সিল্ক শাড়ী”।

চাইলে কিওয়ার্ড রিসার্চ টুল ব্যবহার করে আরও ভালো শব্দ খুঁজে নিতে পারেন। তবে কিওয়ার্ড যেন প্রাকৃতিকভাবে লেখা হয়, অযথা গেঁথে দেওয়া যেন মনে না হয়।

২. রিভিউ দিতে অনুরোধ করুন এবং রিপ্লাই দিন

গুগল রিভিউ অনেকটাই গ্রাহকের চোখে সামাজিক প্রমাণ (Social Proof) এর মতো কাজ করে। ২০২৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৩% মানুষ স্থানীয় ব্যবসা খুঁজলে প্রথমে রিভিউ দেখে।

তাই খুশি ক্রেতাদের বিনয়ের সাথে অনুরোধ করুন যেন তারা গুগলে রিভিউ দেয়। আর প্রতিটি রিভিউয়ের উত্তর দিন—ভালো হলে ধন্যবাদ জানান, আর নেতিবাচক হলে সমাধানের চেষ্টা দেখান।

রিভিউ নেওয়ার কয়েকটি কার্যকর উপায়:

  • বিক্রির সময় সরাসরি বলুন: “ভালো লাগলে গুগলে রিভিউ দিলে খুব খুশি হব।”
  • অনলাইন অর্ডারের পর ধন্যবাদ বার্তায় রিভিউ লিংক দিন।
  • রসিদের পেছনে বা ব্যাগে একটি ছোট কার্ড দিন: “আপনার মতামত দিন গুগলে।”
  • সোশ্যাল মিডিয়াতে মাঝে মাঝে রিভিউ দেওয়ার অনুরোধ পোস্ট করুন।
  • দোকানে ছোট একটা QR কোড সহ সাইন দিন: “আমাদের রিভিউ দিন গুগলে।”

৩. Google Posts ব্যবহার করুন

Google Posts মানে আপনার প্রোফাইলে সরাসরি ছোট ছোট আপডেট বা অফার প্রকাশ করা। এতে আপনার প্রোফাইল সবসময় আপডেট থাকে, এবং ক্রেতারা দেখে বুঝতে পারে যে আপনি সক্রিয়।

কী কী পোস্ট দিতে পারেন?

  • বিশেষ অফার ও ডিসকাউন্ট (যেমন: “এই সপ্তাহে ২০% ছাড়!”)
  • নতুন পণ্য বা জনপ্রিয় পণ্যের স্টক ফিরেছে এমন তথ্য
  • দোকানে কোনো ইভেন্ট হলে তার ঘোষণা
  • মৌসুমি টিপস বা হেল্পফুল ইনফো (যেমন: ঈদ গিফট গাইড)
  • গ্রাহক কৃতজ্ঞতা বা মাইলস্টোন উদযাপন

এসব পোস্টে কিওয়ার্ড যুক্ত করলে SEO-তেও ভালো ফল পাবেন।

৪. উচ্চমানের ছবি ও ভিডিও দিন

মানুষ দোকানে আসার আগে দেখতে চায়, জায়গাটি দেখতে কেমন।
তাই দিন—

  • দোকানের বাইরের ছবি (রাস্তা থেকে চিনে ফেলার জন্য)
  • ভিতরের সাজানো পরিবেশের ছবি
  • পণ্যের ছবি

আরও ভালো হয় যদি ছোট ভিডিও যোগ করেন—যেমন নতুন পণ্যের আনবক্সিং বা দোকানের ৩৬০ ডিগ্রি ভিডিও।

অন্ধকার, ঝাপসা ছবি বা স্টক ফটো নয়— বাস্তব ছবি ব্যবহার করুন, যাতে গ্রাহকের আস্থা বাড়ে।

৫. বুকিং বা কেনাকাটার সুবিধা চালু করুন

গুগল প্রোফাইল শুধু তথ্য দেখানোর জায়গা নয়—এটি থেকে সরাসরি অ্যাকশনও নেওয়া যায়।

যেমন:

  • যদি আপনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট-ভিত্তিক ব্যবসা চালান (যেমন: ব্রাইডাল ফিটিং বা জুয়েলারি কনসালটেশন), তাহলে বুকিং লিংক যুক্ত করুন।
  • যদি আপনার ওয়েবসাইটে পণ্য বিক্রি হয়, তাহলে “Order Online” বাটন বা লিংক যুক্ত করুন।
  • চাইলে প্রোফাইলেই “Products” অংশে আপনার জনপ্রিয় পণ্যের ছবি ও দাম যুক্ত করতে পারেন।

৬. গুরুত্বপূর্ণ Attribute যোগ করুন

আপনার প্রোফাইলে “Attributes” নামক একটি অংশ থাকে, যেখানে আপনি কিছু ট্যাগ বা চিহ্ন যোগ করতে পারেন।
যেমন:

  • Wheelchair accessible
  • Free parking
  • Women-owned
  • Prayer room available

এসব তথ্য গুগলের ফিল্টারে সাহায্য করে। অনেকেই নির্দিষ্ট করে “kids friendly” বা “women-owned” দোকান খোঁজেন—সেক্ষেত্রে আপনার প্রোফাইল তাদের সামনে ভেসে উঠবে।

প্রোফাইল ড্যাশবোর্ডে গিয়ে যে সব অ্যাট্রিবিউট প্রযোজ্য, তা বেছে নিন।

শেষ কথা

একটি ভালোমতো সাজানো গুগল বিজনেস প্রোফাইল শুধু লোক দেখানো তথ্য নয়—এটি আপনার ব্যবসার জন্য একজন ডিজিটাল সেলসপারসন হয়ে উঠতে পারে।

আপনার প্রোফাইলের প্রতিটি অংশ যত যত্ন করে সাজাবেন, ততই বেশি গ্রাহক আপনাকে খুঁজে পাবে এবং বিশ্বাস করবে।

Put Your Opinion